আত্মা ও মন কি তা নিয়ে বিস্তারিত পড়ুন এবং আপন আত্মা ও মনের সম্পর্কে জানুন।
বৈদিক শাস্ত্রে একটি সুন্দর দৃষ্টান্তের মাধ্যমে আত্ম, বুদ্ধি. মন, ইন্দ্রিয়, দেহ এগুলির পার্থক্য বোঝানো হয়েছে। একটি রথ । সেই রথের উপর আরোহী বসে আছে। সেই রথটিকে চালনা করছে সারথী।পাঁচটি ঘোড়া রথটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ঘোড়াদের লাগাম গুলি হাতে ধরে সারথী ঘোড়া গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
আমাদের দেহটি হচ্ছে রথ। এই দেহের মধ্যে রয়েছে ‘আমি’ বা আত্ম। দেহরূপ রথের আরোহী আত্ম। দেহরূপ রথটি চালনা করছে সারথী বুদ্ধি। এই দেহরূপ রথটি পাঁচটি ঘোড়ারূপ উন্দ্রিয় সমন্বিত। অর্থাৎ, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় হচ্ছে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক। বুদ্ধি ঘোড়ারূপ ইন্দ্রিয় গুলিকে লাগাম রুপ মন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করছে। মনকে লাগামের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
বুদ্ধি রূপ সারথী যদি বিকৃত হয়, অর্থাৎ, টিক না থাকে তবে সে লাগাম ধরে থাকলেও ঘোড়া গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। বিবেক বুদ্ধি অনুসারে তেমনই মনটা যদি চলে তবে দুর্বার ইন্দ্রিয় গুলিকে সংযত করা সম্ভব হয়। স্বভাব চঞ্চল ঘোড়া গুলি জাগতিক উদ্দীপনায় যথেচ্ছাচার করতে পারে, নিয়ন্ত্রনের বাইরে বিপজ্জনক ভাবে চলতে পারে। তখন অকালে রথ ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সারথী বিকারগ্রস্ত হয় এবং আরোহী আতঙ্কিত ভাবে অসহায় বোধ করতে থাকে। আমাদের চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বাও ত্বক যথাক্রমে জড় জাগতিক রূপ, স্বাদ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ সুখভোগের দিকে দুর্বারিত ভাবে ধাবিত হলে ভজন সাধনের উপযুক্ত শ্রেষ্ঠ দুর্লভ নরদেহটি অকালে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। মোহগ্রস্ত বুদ্ধি ভ্রষ্ট জীবন খুবই বিপজ্জনক। শেষে হতাশাচ্ছন্ন জীব জন্ম মৃত্যুর ভব সংসারে ত্রিতাপ দুঃখতে জর্জরিত হয়।
শ্রীমদ্ভবগদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "মনই আত্মার বন্ধু। মনই আত্মার শত্রু। নিয়ন্ত্রিত মন বন্ধু। অনিয়ন্ত্রিত মন শত্রু।"
ভগবান আরও বলেছেন,
"উদ্ধরেদাত্মনাত্মনং নাত্মানমবসাদয়ে। মোহগ্র
আত্মৈব হ্যাত্মানো বন্ধুরাত্মৈর রিপুরাত্মনঃ।।"
” মানুষের কর্তব্য হচ্ছে তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা। মনের দ্বারা আত্মাকে (নিজেকে ) অধঃপতিত করা কখনই উচিত হয়। মন জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়ে থাকে।” (গীতা ৬/৫)
অমৃতবিন্দু উপনিষদে বলা হয়েছে,
"মন এব মনুষ্যাণাং কারণং বন্ধমোক্ষয়োঃ।
কন্ধায় বিষয়াসঙ্গো মুক্ত্যৈ নির্বিষয়ং মনঃ।।"
”মনই মানুষের বন্ধন অথবা মুক্তির কারণ। বিষয়ের প্রতি মনের অনাসক্তি হচ্ছে মুক্তির কারণ।” (অঃ বিঃ উঃ ২)
আমাদরে আধুনিক সমাজে একটি গ্রাম্য বুলি শোনা যায়- ‘মন যা চায় তাই খাও। আত্মা নারায়ণ সুখী হলে সবই সুখময় হয়।’ এই ধরনের কথা ভগবদ বিরুদ্ধ। শাস্ত্রবিরুদ্ধ নাস্তিক বিষয় ভোগ-লোলুপদের মনগড়া বুলি মাত্র। কলির মানুষের মন সর্বদা কলুষিত হতে চায়। যেমন জল সর্বদা নিম্ন দিকে যেতে চায়। শিশু সর্বদা ধুলো কালি খেলতে চায়। তেমনই মন সর্বদা পাপাচার করতে চায়। নেশা করা, অবৈধ সঙ্গ করা, আমিষ আহার, জুয়াখেলা এই সমস্ত শাস্ত্র নিষিদ্ধ পাপাচারে মত্ত হতে চায়। মন যা চায় তাই করো কথাটিতে পাপাচারে মত্ত থাকলেও ক্ষতি নেই এই রকম বদবুদ্ধি পোশন করে। ফলস্বরূপ অবশ্যম্ভাবী নরকগামী হতেই হবে।
আত্মা নারায়ণ সুখী হলে সবই সুখময় হয়। এই রকম কথাটিতে আত্মাকে নারায়ণ জ্ঞানে অর্থাৎ নিজেকে ভগবান মনে করে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে জীবাত্মা স্বরূপত ভগবানের দাস মাত্র। কিন্তু দাসই নিজে প্রভু হতে চায়। প্রভুর সুখ বিধান না করে নিজেই সুখী হতে চায়। ভগবানের নির্দেশ না মেনে নিজের সুখভোগ চরিতার্থ করতে চায়। একটি আসুরিক মতবাদ আছে,
"যাবৎ জীবেৎ সুখং ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ"
অর্থাৎ যতদিন বাঁচো সুখে বেঁচে যাও। ঋণ করেও ঘি খেয়ে যাও। সারাটা জীবন ঋণ করো, আর যাই করো ভোগ করে যাও। ঋণ শোধ করার কথা নেই। এই ধরনের অসুরভাবাপন্ন ব্যক্তিরা সমাজে ছেয়ে গেছে।
আর এক ধরনের বুলি শোনা যায়। ‘যা খুশি তাই কর, মুখে হরিনাম কর।’ অর্থাৎ, পাপপুণ্য ধর্ম-অধর্ম যা ইচ্ছা, যা তোমাকে সুখী করে তাই-ই করো। আর যদি নরকের ভয় থাকে তবে উদ্ধার পাওয়ার জন্য হরিনামটা মুখে করতে পারো। অথচ এই বুলিকারদের স্মরণ রাখা উচিত যে, বহু পূর্বে পাপ করা আর নাম করা বিষয়ে মহর্ষি ব্যাসদেব হরিনামের দশবিধ অপরাধের ধারায় ৭ নম্বরে অপরাধী হয়ে দুর্ভোগ ভুগতে হবে বলে নির্দেশ করে গেছেন।
অসাধারণ
উত্তরমুছুনঅসাধারণ
উত্তরমুছুন